তখন প্রথম টার্মের ক্লাশ শুরু হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢুকে সবই আগ্রহ নিয়ে দেখি। ক্যাফের পাশে বিদেশী কয়েকটা পেট্রোলিয়াম কম্পানীর জব ফেয়ার
চলছিল। আমার পড়াশোনার এলাকার মধ্যে পড়ে না, তবু ঘুরে দেখতে অসুবিধা কি? অর্ধেকের মত বাংলাদেশ কেন্দ্রিক চাকরী, বাকিগুলো
সাউথ এশিয়া বেজড। সুন্দর সুন্দর মেয়েরা এসেছে। এরা কি অফিসের লোকজন নাকি ডেকে আনা ভলান্টিয়ার বোঝার চেষ্টা করছি। আমাদের এখান
থেকে পাশ করে যাওয়া সিনিয়র ভাইদেরকে দেখলাম লেকচার ঝেড়ে যাচ্ছে। লিফলেট নেড়েচেড়ে চলে যাবো ভাবছি, বুথগুলোর পেছনে হঠাৎ চোখ
পড়লো। মেয়েটা ফ্রী টিশার্টের কার্টন খুলছিল, এক মুহুর্তের জন্য আমার দিকে তাকিয়ে টিশার্টগুলো নিয়ে পেছনের দিকে চলে গেল। অল্প সময়ের
জন্য মনে হলো পৃথিবীটা থেমে গেছে। নাটালী পোর্টম্যানের মত দেখতে। এত ছেলেপেলের মধ্যে আমাকে কেন? কে জানে হয়তো এমনিই তাকিয়েছে।
এদিক ওদিক চাইলাম, পাশে সরে গিয়ে খুঁজে বের করার চেষ্টা করলাম অনেকক্ষন। ভীড়ের মধ্যে কোথায় হারিয়ে গেছে বুঝলাম না।
এরকম হয় যে কাউকে স্বপ্নে দেখার পর কয়েকদিন সে মাথার মধ্যে থাকে। সেদিন জব ফেয়ারে দেখা মেয়েটাও মাথা থেকে যাচ্ছিল না। ও কি
ক্যাম্পাসেরই মেয়ে, নাকি বাইরে থেকে জবওয়ালাদের সাথে এসেছে। এমনিতে আমাদের ক্যাম্পাসে মেয়ে কম। দশজনে একজন বড় জোর। এর বড়
অংশ আবার ক্যাকটাস টাইপের। হাজার তিনেক ছাত্রছাত্রীর মাঝে লুকিয়ে থাকলে এত দিনে চোখে পড়তো। এই শহর এমন যে এখানে মিসড
কানেকশন সারাজীবন মিসড থেকে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। আমার এদিকে ফারিয়ার সাথে দুমাস আগে ব্রেকআপের পর যাকে দেখি তাকেই ভালো
লাগে অবস্থা। মনে মনে আশ্রয় খুঁজে বেড়াচ্ছি অনেকদিন হলো। ঢাকায় বিয়ের জন্য বৌ পাওয়া যায়, চোদার জন্য সস্তায় মাগীও আছে, কিন্তু প্রেম করার জন্য গার্লফ্রেন্ড দুর্লভ। সকাল বিকাল বাসে যাওয়া আসা করি আর খুঁজে বেড়াই। এরকম একদিন দুপুরে দুটার দিকে বাসে ছেলেমেয়েরা
উঠছে, আমি ক্যাফের সামনের দেয়ালে বসে সেশনাল শুরু হওয়ার জন্য অপেক্ষা করছি। ঘাড় ঘুড়িয়ে এদিক সেদিক তাকাই। অপরিচিত মেয়ে দেখলে
ভালমত দেখে নিশ্চিত হওয়ার চেষ্টা করি এই সেই মায়াবিনী না তো? মোহাম্মাদপুর রুটের বাসটা সামনে দিয়ে চলে যাচ্ছিলো। মুহুর্তের মধ্যে শকওয়েভ বয়ে গেল আমার শরীরে। সেই মুখ বাসের জানালায়। এক চিলতে হাসি দিয়ে মুখটা ফিরিয়ে নিল মেয়েটা। একটা আনন্দ মেশানো উৎকন্ঠায় টের পেলাম।
তাহলে আমাদের এখানকারই মেয়ে।
সেদিন খুব ফুর্তি নিয়ে কেমিস্ট্রি ল্যাবে গেলাম। পরদিন ক্লাশ বাদ দিয়ে একটা বাজার আগে থেকেই মোহাম্মাদপুর রুটের বাসের সামনে ক্যাম্পিং
করলাম। একজন দুজন করে অনেক ছেলেমেয়ে বাসে উঠলো। দুটার সময় বাসটা ছেড়েও গেল। কিন্তু তার দেখা নেই। হয়তো ওর সেশনাল আছে।
পুরো দুই সপ্তাহ খোঁজাখুঁজি চললো। এত অল্প কিছু ছাত্রছাত্রীর মধ্যে কিভাবে লুকিয়ে আছে ভেবে পাই না। আবারও একদিন ক্লাশ ফাঁকি দিয়ে
খুঁজছি, গেটের দিকে চোখ পড়তে গলা শুকিয়ে গেল। বুকে হাত বেধে সে তখন হেঁটে আসছে। সরাসরি আমার দিকেই মনে হয়। কোত্থেকে উদয় হয়
কে জানে। আমার সামনে এসে দাঁড়ালো। কান মাথা গরম হয়ে কি করবো বুঝতে পারছি না। আমিও উঠে দাঁড়ালাম।
- ক্লাশ ফাঁকি দিয়ে আমাকে খুঁজে লাভ নেই।
আমি ঢোক গিলে বললাম, উ।
- যাও, ক্লাশে যাও।
তারপর যেভাবে এসেছিল সেভাবে হেঁটে গেটের বাইরে গিয়ে একটা রিকশায় উঠলো। আমি নিশ্চিত হওয়ার চেষ্টা করলাম এগুলো সবই সত্যি ঘটলো
কি না। আমাদের ব্যাচের মিতু আমাকে দেখে বললো, কি রে রিমি আপু তোকে কি বললো?
- রিমি আপু?
- হু, চিনিস না? আমাদের ডিপার্টমেন্টের, এবার পাশ করে যাবে। সবাই যমের মত ভয় পায়।
- ও!
এই নাটালী পোর্টম্যান তাহলে এখানে রিমি নামে চলছে। কিভাবে ওর নাগাল পাওয়া যায় ভেবে কোন কুল কিনারা পাচ্ছিলাম না। ফ্রেশম্যান স্টুডেন্ট আমি, রিমির কাছে অফার করার মত তেমন কিছু নেই। একমাত্র সম্পদ ইয়ুথফুল এনথুসিয়াজম। সেটাও রিমির লিস্টে কতটা উপরে আছে সন্দেহ।
ভেবে ভেবে তবু হাল ছাড়তে মন চায় না। এর মধ্যে আরো কয়েকবার ওদের ডিপার্টমেন্টে ল্যাবে গিয়ে দেখে এসেছি। এখানে সহজে পাওয়া যায়।
রিমিও আড়চোখে দেখেছে, কিছু বলে নি। কনফ্রন্ট করতে হবে। মনোভাবটা জানা দরকার। সোনালী ব্যাংকের চিপা গেট দিয়ে ঢুকতে গিয়ে সে
সুযোগ হয়ে গেল।
- রিমি?
- রিমি?
ও আবার সেই হাসিটা ঝুলিয়ে তাকালো, কি? তোমাকে কি বলেছি আমি?
- সেটা জানি। তারপরও একটা সুযোগ চাই, একবার শুধু?
- কি রকম?
- এমনি। এক ঘন্টার জন্য লাঞ্চ বা ডিনার, আর কোন ঝামেলা করবো না।
রিমি গায়ে মাখলো না। অনেক অনুরোধের পর আমার সেলফোন নাম্বারটা কাগজে লিখে দিলাম। যাই ঘটুক, আমি বেশ ভালো বোধ করা শুরু
করেছি তখন। অন্তত সামনাসামনি বলতে পেরেছি। সপ্তাহ মাস ঘুরে টার্ম ফাইনাল চলে এলো। এর মধ্যে অনেকবার ডিপার্টমেন্টে গিয়ে ঘুরে আসা
হয়েছে। কথা হয় নি আর। আমি তাকাই, ও আড়চোখে দেখে, কিছু বলে না। শেষ পরীক্ষার আগের দিন সন্ধ্যায় অচেনা নাম্বার থেকে একটা
কল এলো। বিরক্ত হয়ে ধরলাম।
- তোমার পরীক্ষা শেষ কবে?
- কে বলছেন?
- কে বলছি? রিমি … রিমি…
তাড়াতাড়ি বারান্দায় চলে গেলাম ফোন নিয়ে, অল ইম্পরট্যান্ট কলটা তাহলে এলো।
- কালকে বিকালে শেষ।
- ওহ বিকালে আবার। ঠিক আছে তাহলে ডিনারই হোক।
পরীক্ষা শেষ করলাম কোনমতে, বন্ধুদের সাথে আড্ডা না দিয়ে উত্তরায় বাসায় চলে এলাম। চামড়া তুলে গোসল করে, চুলে জেল মেখে আবার
ধানমন্ডি। সময়ের আধা ঘন্টা আগে থেকে হাজির। মেয়েরা দেরী করে আসে সেটা জানি। প্রথমদিনই টের পেলাম রিমির ব্যাপারটা আলাদা। সে
আটটা বাজার পাঁচ মিনিট আগে রিকশা থেকে নামল।
- তুমি আমার আগেই চলে এসেছ দেখছি?
তিন মাস পর ডেটিংয়ে এসেছি। ফারিয়ার চেয়ে একশগুন দামী মেয়ে। অবশ্য নাগালে আছে কি না সেটা জানি না। ওয়েটার পিছনের দিকে বসিয়ে
দিল।
- তোমার নামটা কিন্তু জানা হয় নি?
- তানিম।
ইউনি লাইফ কেমন যাচ্ছে, পড়াশোনা নিয়ে কথার পর রিমি বললো।
- এখন বলো, কি খুঁজছো আমার কাছে?
- আমি জানি না। আপনাকে জব ফেয়ারে দেখার পর আমার মাথা ওলট পালট হয়ে আছে, এটুকু বলতে পারি।
- রিয়েলী?
- ভেরী রিয়েল।
- কারন?
- নিজেও জানি না। ভেবে দেখি নি।
- এখন ভাবো? বের করো, কারন জানা দরকার।
রিমি প্রায় ঘন্টাখানেক জেরা করে বের করতে চাইলো আমার আগ্রহের কারন কোনটা। সত্যি বলতে কি আমি নিজেও নিজেকে এসব প্রশ্ন করে দেখি নি। রিমি খুব মেথডিকাল।
- লোকে বলে মেয়েদের মন বোঝা কষ্ট। অনেস্টলী ২৩ বছর হয়ে গেল অথচ আমি ছেলেদের মন পড়তে পারি না। কি চাও তোমরা?
- স্পেল বাউন্ড মেই বি…
- নো সাচ থিং, আস্ক ইয়োরসেল্ফ, তারপর আমাকে জানিও।
লেভেল টুতে বসে তার রিলেশনশীপ ভেঙে যাওয়ার পর থেকে সে একাই আছে। খুবই ভাল খবর আমার জন্য। রিমি আমার চেয়ে শার্প সন্দেহ নেই।
তার চিন্তাভাবনার পদ্ধতি আলাদা, ভীষন কৌতুহলী। সবকিছু ভেঙেচুরে দেখতে হবে তাকে।
- তোমার একটা ভালো গুন বলো তো।
- আমি শান্ত এবং এডভেঞ্চারাস, যেমন প্রয়োজন হলে অনেক ঝুঁকি নিয়ে কাজ করতে পারি।
রিমি জোর করে খাওয়ার বিল দিল।
রেস্টুরেন্ট থেকে বের হয়ে বিদায় নিলাম, আবার দেখা হবে কি না সে প্রসঙ্গে কিছু বললো না। আমি অবশ্য
যে পরিমান চার্জড আপ হয়েছি একমাস কেটে যাবে খালি হওয়ার আগে। ফুরফুরে মেজাজে বন্ধের দিন গুলো কেটে যেতে লাগলো। ক্লাসমেটদের সাথে
ঘুরি টুরি, ফোনের জন্য অপেক্ষা করি। এক সপ্তাহ পরে আবার সেই নাম্বারটা থেকে কল। ধড়মড় করে উঠে গিয়ে ধরলাম।
- ফলোআপ রিপোর্ট পেলাম না যে?
- ফলোআপ?
- কেন সেরকমই তো কথা ছিল।
- এ্যা, মনে ছিল না, বা বুঝতে পারি নি। এখন ফোনে বলবো?
- ফোনে তাড়াহুড়ো করে বলার দরকার নেই, আজকে বিকালে আমার এখানে আসো।
রিমি পাশ করার আগে থেকেই ঐ পেট্রোলীয়ামটাতে পার্ট টাইম চাকরী করছে। গুলশানে ওর অফিসে গেলাম।
- আপনার সাবজেক্টের সাথে তেল কোম্পানীর রিলেশন প্রেটি স্ট্রেঞ্জ!
- স্ট্রেঞ্জ কেন? রিনিউয়েবল এনার্জিতে রিসার্চের একটা বড় অংশ তেল কোম্পানীগুলো করছে। অল্টারনেট সোর্স পাওয়া গেলে ওরা ক্ষতিগ্রস্ত হবে
সবার আগে।
- আমার ধারনা ছিল ওরা এর বিপক্ষে হবে।
- শোন তোমাকে বলি, প্রস্তর যুগ যেমন পাথরের অভাবে শেষ হয় নি, সেরকম তেলের যুগও তেলের অভাবে শেষ হবে না, অল্টারনেট
এনার্জির জন্য হবে। এটা অবশ্য আমার কথা না, খুব সম্ভব সৌদি তেলমন্ত্রী বলেছিল। কিন্তু ভেরী রিজনেবল।
কথা বলতে বলতে নীচের ফ্লোরে ক্যাফেতে চলে এলাম।
- ডু ইউ ফীল ইট, মিথ্যা বলবে না।
- ইটস রিয়েল, বললাম আপনাকে। এরকম আগেও হয়েছে, শুধু এবার ইনটেনসিটি বেশী।
- উদাহরন শুনি?
- সামর্থ্য থাকলে আপনাকে নিয়ে পালিয়ে যেতাম আমি, অনেস্টলী বলছি।
- কোথায় পালিয়ে যেতে?
- কোন দ্বীপে হয়তো…
- কিভাবে?
- একটা প্ল্যান ছিল ফাইভ সিক্সে থাকতে। সাবমেরিন বানাবো, সেভাবে। এখন ঠিক জানি না কিভাবে করবো। মানে জানলে তো সেটা করেই
ফেলতাম বসে থাকতাম না।
- আচ্ছা ধরো সাবমেরিনে করে গেলাম, তারপর?
- তারপর একা দ্বীপে আমি হব এডাম আর আপনি ইভ।
- পুরোনো কাহিনী। এর বাইরে আর কিছু?
- আমার ধারনা এডাম ঈভ টাইপের ফ্যাসিনেশন আমাদের অন্তত ছেলেদের মাথার ভেতরে খুব স্ট্রং। কারো প্রেমে পড়লে তাকে নিয়ে এরকম ইচ্ছা
অনেকেরই হয়। ইভকে প্রটেকশন দিয়ে রাখার একটা ইচ্ছা তৈরী হয়। দ্বীপে হয়তো সেটা সহজ?
- ওকে, তোমাকে দুইদিন সময় দিলাম। প্রচলিত কাহিনীর বাইরে কিছু শুনতে চাই।
এরপর মাঝে মাঝেই ওর অফিসে যেতাম। ওর ব্রিটিশ ম্যানেজার ক্রিস্টোফার আর তার ওয়াইফ বেথ এর সাথে পরিচয় হল একদিন। বেথ ফিসফিসিয়ে রিমিকে বললো, হি লুকস ভেরী ইয়াং।
- হি ইজ, ফ্রেশম্যান ইন মাই স্কুল।
- ওহ দ্যাটস ওয়ান্ডারফুল। ইউ উইল নেভার রিগ্রেট।
এতদিনে একবার মাত্র অল্প সময়ের জন্য হাত ধরার সুযোগ পেয়েছি। তবে এ নিয়ে আমার অভিযোগ নেই। ওভারঅল অদ্ভুত সময়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি, বেস্ট টাইম অফ মাই লাইফ। রিমি বুদ্ধিমতী, সেল্ফ কনফিডেন্ট মেয়ে। যে কারনে সে খুব ডিরেক্ট, এবং সহজবোধ্য। অথবা স্রেফ নিজের অবস্থানের কারনে ম্যানিপুলেটিভ হতে হয় না। আমি নিজে খুব কমফোরটেবল বোধ করি, হেড গেমস নিয়ে ভাবতে হচ্ছে না। যা ভাবি সেটাই বলি, রিমিও সেভাবে আচরন করে। একদিন বিকালে সে বললো, অফিসের কনফারেন্সে সে জাকার্তা যাচ্ছে, ভাবছে আমাকে সঙ্গে নেয়া যায় কি না।
- কি? আমি যাবো? কিভাবে? আমি তো আপনার ওখানে চাকরী করি না?
- ভাবছি ক্রিসকে বলে একটা ইনভাইটেশন যদি বের করা যায়। তাহলে তোমার সেই দ্বীপের এডভেঞ্চারটা হবে
বলে সে হেসে ফেলল।
- ওহ আপনি তাহলে অপছন্দ করেন নি?
- দেখা যাক, কল্পনা আর বাস্তবে কতটুকু মিলে।
দুদিন পর রিমি ইনভাইটেশন লেটার দিল। বেশ দৌড়াতে হলো ভিসা টিকেটের জন্য। ল্যাপটপ কেনার জন্য টাকা জমাচ্ছিলাম। প্রায় একবছরের টিউশনী করে জমানো ত্রিশ হাজার। রিমিই বেশীর ভাগ খরচ বহন করবে, আমি আমার চেষ্টা করলাম। বন্ধু বান্ধবের কাছ থেকে ধার নিলাম আরো দশ। বাসায় বললাম নেপাল যাচ্ছি ফ্রেন্ডদের সাথে, আম্মার কাছ থেকে কিছু টাকা বের করে নিলাম। ভীষন থ্রীল অনুভব করছি। যা এড্রেনালিন শরীরে তৈরী হয় পুরোটাই মনে হয় খরচ হয়ে যায়। রিমি নিজেই একদিন আমার হাত চেপে ধরে বললো, যাচ্ছি তাহলে আমরা তাই না?
- তাই তো মনে হচ্ছে।
- হাউ ডু ইয়ু ফীল?
- আগ্রহী! উত্কন্ঠিত!
রিমির পরামর্শে শুধু একটা ক্যারি অন লাগেজ নিয়ে বাসা থেকে বের হলাম। ওর অফিস থেকে গাড়ীতে দিয়ে আসবে এয়ারপোর্টে। মাঝরাতের মালয়শিয়ান এয়ারলাইন্সের ফ্লাইট। এর আগে তিন চারদিন ভালোমত কাজকর্ম করতে পারছিলাম না। ঘনিষ্ঠ বন্ধুদেরকেও বলা হয় নি যে দেশের বাইরে যাচ্ছি। টেন্সড নার্ভ নিয়ে রিমির অফিসের সামনে ওকে দেখলাম। শার্ট প্যান্ট পড়ে এসেছে। আমাকে বললো, রেডি?
- হু।
গাড়িতে উঠে পাশে বসে আমার হাতটা নিল, হাতে হাত চেপে তারপর অনেকক্ষন আমরা নিজেদের দিকে তাকিয়ে শেষে হেসে ফেললাম।
রিমি স্বভাবসুলভ মুচকি হেসে বললো, ইটস হ্যাপেনিং। ফর রিয়েল।
আমি হাতে জোরে চাপ দিয়ে উত্তর দিলাম।
আমি এর আগে খুব বেশী প্লেনে উঠিনি। জানালা দিয়ে রাতের ঘুমন্ত ঢাকা শহর দেখতে দেখতে মেঘের উপরে চলে গেল প্লেনটা। রিমি বললো, এখন ঘুমিয়ে নেই, এনার্জি ধরে রাখতে হবে।
চার ঘন্টা পর কুয়ালালামপুর। এখানে নয় ঘন্টা যাত্রা বিরতি।
এয়ারপোর্টে খেয়ে টুকটাক কথা বার্তা বলছি আমরা। অনেক বাংলাদেশী বা ভারতীয় উপমহাদেশের লোকজন। রিমি আগেও কয়েকবার জাকার্তা এসেছে। সে বললো, পরিচিত লোকজন থাকা অস্বাভাবিক না। মাত্র কয়েকঘন্টা আমরা একসাথে অথচ আমার মনে হতে লাগলো আগাগোড়া আমরা একসাথেই ছিলাম। কাচের জানালা দিয়ে প্লেন ওঠা নামা দেখলাম। রিমি বললো, বাংলাদেশের মত গরীব দেশে নিউক্লিয়ার এনার্জি ছাড়া সমস্যার সমাধান হবে না। ফ্রান্স যেমন তাদের ৮০% ইলেকট্রিসিটি নিউক্লিয়ার সোর্স থেকে তৈরী করে … শুনতে শুনতে ওর হাত ধরে মুঠোয় নিলাম, ওর হাত থেকে যে পরিমান চার্জড পার্টিকল আমার শরীরে ঢুকছে ঐ এনার্জিরই বড় প্রয়োজন অনুভব করছি।
জাকার্তা পৌছলাম সন্ধ্যার সময়। এয়ারপোর্টে রিসিভ করার জন্য লোক দাঁড়িয়ে ছিল। তার সাথে গাড়ীতে করে হোটেল। ক্রিস্টোফার আর বেথও আছে এই হোটেলে, তারা একদিন আগে এসেছে। বাইরে ভাল রকম বৃষ্টি। ডাবল বেডের রুম। রিমি ঢুকে দুরের বেডটা দেখিয়ে বললো, ওটা তোমার। হালকা হয়ে নাও, তারপর নীচে গিয়ে ডিনার করবো। হাত মুখ ধুয়ে জামা কাপড় বদলে নিলাম। সেরকম কিছু নিয়ে আসি নি, এগুলোই রিসাইকেল করে করে চলতে হবে। রিমিও চেঞ্জ হয়ে নিল। হোটেলের নীচের ফ্লোরে রেস্তোরা। ক্রিস আমাকে দেখে বললো, হাউ’জ গোয়িং ইয়ং ম্যান?
- ফাইন, আই গেস।
- এনজয় দা টাইম, দিজ আর ওয়ান্ডার ইয়ার্স অফ ইয়োর লাইফ।
খেয়ে দেয়ে রিমি ওদের কাছে বিদায় নিল। উপরে উঠতে উঠতে বললো, কালকে ভোরে উঠতে হবে, সকালের সেশনে আমার প্রেজেন্টেশন। এই দুইদিন কিছু মনে করো না, আমি একটু সেলফিশ থাকবো, তারপর তোমার সাথে তিনদিন।
- নো প্রবলেম, আমার জন্য চিন্তা করার দরকার নেই।
সকালে আমি উঠতে উঠতে দেখি রিমি রেডী হয়ে চলে যাচ্ছে। যাওয়ার আগে কাছে দাঁড়িয়ে তারপর বললো, যাই।
এগারটা পর্যন্ত হোটেলের ফ্রী ব্রেকফাস্ট। মাফিন ওয়াফল টাইপের ভুয়া কিছু খাবার। সকালে গোসল দিয়ে বের হয়েছি, ফ্রেশ লাগছিল। বের হয়ে রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে মানুষজন দেখতে লাগলাম। মুসলিম দেশ কিন্তু রাস্তাঘাটে অনেক মেয়ে। বাংলাদেশের মত রক্ষনশীল না মনে হয়। স্কার্ফ পড়ে আছে অনেকে, তবু ঢাকার মত উগ্র হিজাবী কাস্টমার কম। অবশ্য মেয়েরা কাজ না করলে কি আর বাংলাদেশের পাঁচগুন পার ক্যাপিটা জিডিপি হয়। আমাদের দেশে তো পড়াশোনা করে মেয়েরা ঘরে বৌ হয়ে বসে থাকে, বেশীরভাগ হাজবেন্ড, শ্বশুর-শাশুড়ী ঘরের বৌকে চাকরী করতে দিতে চায় না। সময় আর সম্পদের কি নিদারুন অপচয়। স্টারবাকস দেখে ঢুকলাম। নাম শুনেছি অনেক। দাম দেখে চোখ মাথায় উঠলো। ভদ্রভাবে বের হয়ে যাওয়া দরকার। রাস্তায় এসে আবার মেয়ে দেখা শুরু করলাম। বাংলাদেশের পাহাড়ী মেয়েদের সাথে মিল আছে, কিন্তু এরা একটু পাতলা, আর কালচে। কিছু মেয়েকে মনে হয় এক হাতে কোলে নিতে পারবো।
গত একমাসের ঘটনাগুলোর একটু রিফ্লেকশন দরকার। রিয়েলী! ফারিয়ার সাথে ছাড়াছাড়ির পর একদম মুষড়ে পড়েছিলাম, রিজেক্টেড, বিট্রেইড। এখন টের পাচ্ছি পৃথিবীতে সাড়ে তিন বিলিয়ন মেয়ে ছিল।
আর আমি কিনা আশ্রয় খুজে পাগল হচ্ছিলাম। ফারিয়াকে ধন্যবাদ দিতে হয় আমাকে ছেড়ে যাওয়ার জন্য। এক ফারিয়ার বিনিময়ে পুরো জগতটাই নিজের মনে হচ্ছে। হোটেলের নীচে রেস্তোরায় দুপুরের খাবার খেলাম।
সন্ধ্যার অনেক পরে এল রিমি। ওর চেহারায় দেখলাম বেশ টায়ার্ড।
- স্যরি, সারাদিন ভীষন ব্যস্ততা গিয়েছে।
- ধুর, এজন্য স্যরি বলার কিছু নেই। আমি আশে পাশে ঘুরে ভাল সময় কাটিয়েছি।
তাড়াতাড়ি খেয়ে রিমি ল্যাপটপে তার পরবর্তি দিনের পেপার রেডি করছিল। কালকের পর কি হবে ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে গেলাম। সকালে রিমি ধাক্কাধাক্কি করে ঘুম থেকে তুললো, যাচ্ছি আমি। আজকে কিন্তু আধাবেলা সেমিনার। খুব দুরে যেও না।
- ঠিক আছে, দুপুরের মধ্যে রুমে চলে আসবো।
অন্তত এই শহরটাতে টুরিস্ট অনেক। ঢাকায় টুরিস্ট মনে হয় ভয়ে আসে না। ভীড় আর আইনশৃঙ্খলার বাজে অবস্থা। বিশেষ করে মেয়ে টুরিস্ট দেখলে তো দাড়ি টুপী বাঙালীর মাথা খারাপ হয়ে যায়। দেশের একটা বড় অংশ এখনও মধ্যযুগে পড়ে আছে সন্দেহ নেই।
একটার মধ্যে হোটেলে চলে এলাম। গোসল করব কি না ভাবছি। রিমি এখনও বলে নি নেক্সট কোথায় যাবো। শেভ করছি তখন রিমি এসে ঢুকলো।
- তাড়াতাড়ি নীচে চলো।
- কেনো?
- টিকেট কাটবো।
- জাস্ট পাঁচ মিনিট। আপনার পেপার রিডিং কেমন হলো?
- ওকে। চলে আর কি। বাদ দাও। ঝামেলা শেষ এখন নেক্সট প্রজেক্ট।
নীচে গারুদার টিকেট কাউন্টার আছে। রিমি গিয়ে মেডান সিটির টিকেট কাটলো দুটা। সাতশ ডলার। সন্ধ্যায় ফ্লাইট। হোটেল বুকিং দেয়া হলো এখানে থেকে। আমাকে বললো, চলো ব্যাগ পত্র গুছাই। ক্রিস আর বেথ যাচ্ছে বালি। আমি বললাম, মেডান আবার কি জায়গা, কখনো নাম শুনি নি?
- আছে, সুমাত্রায়। বালির মত পপুলার না এই আর কি। আমরা মেদানে রাতে থাকবো, আমরা যাবো টোবা তে।
- টোবা?
- হু। লেক টোবা, ক্যালডেরা। জায়ান্ট ভলকানো আছে ওর নীচে।
- বলেন কি?
- গেলেই দেখবে, আসার আগে অনেক খুঁজেছি। একটু একজটিক প্লেস খুঁজছিলাম যেখানে খুব খরচ না করে যাওয়া যায়।
হোটেলের বাসে এয়ারপোর্টে এলাম। দুঘন্টার ফ্লাইট। ভেতরে ভেতরে আমি বেশ একসাইটেড, রিমি ক্লান্ত। পুরো পথ সে ঘুমিয়ে কাটাল। এখানে একটা জিনিস ভালো যে হোটেলগুলোর শাটল থাকে। নাহলে অচেনা শহরে ঝামেলায় পড়তে হতো। হোটেলে চেক ইন করে রুমে ঢুকতে ঢুকতে রাত এগারটা। হোটেলের মান মোটামুটি, জাকার্তায় যেখানে ছিলাম তার চেয়ে কিছুটা খারাপ। রিমি ঘুমিয়ে উঠে ভাল বোধ করছে। তার সেই ঠোঁট চেপে হাসি দিয়ে বললো, কি হে রোমিও কথা কমে গেল কেন?